Magic Lanthon

               

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

আমাদের সিনেমাগুলো সিনেমা হয়ে উঠছে না

সেলিম আহমেদ

 

দিনকে দিন আমাদের দেশে সিনেমাহল কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিদিন পরিকল্পনা হচ্ছে নতুন নতুন সিনেমা নির্মাণের। প্রচুর সিনেমা নির্মাণও হচ্ছে, কিন্তু দর্শক কেবল দেখছে না। আর আমাদের সিনেমাগুলো সিনেমা হয়ে উঠছে না! উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর শহর থেকে এ গল্পটা বুনতে চাই। একদম হিমশীতল দিনেও সিনেমাহলগুলো উপচে পড়তো দর্শকের ভিড়ে। সাধারণ মানুষের টিকিট সংগ্রহের দীর্ঘ সারি বা টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে সখ্য থাকায় একটু সহজে অথবা চড়া দামে কেনা পরিবারের সদস্যদের জন্য দারুণ আনন্দ¾এখন সিনেমা আর পরিবারের মানুষদের একসঙ্গে বসতে দেয় না। এ শহরে ‘বোস্তান’, ‘লিলি’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘জুয়েল’, ‘বিডিআর’ নামের সিনেমাহল অদৃশ্য হয়ে, এখন শুধু ‘মডার্ন’ টিমটিম করে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এসব সিনেমাহলে কতো যে গল্প আছে, আনন্দ-বেদনা-ভালবাসার গল্প। কতো দর্শক আলো-আঁধারিতে কতো গল্পের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু প্রযোজক আর প্রদর্শকদের ভয়¾যদি দর্শক বিনোদন না পায় তাহলে সিনেমাহলমুখী হবে না, তাই তো বাংলাদেশি সিনেমায় একটা কাটপিসের যুগও ছিলো।

পরিচালক-প্রদর্শক-প্রযোজক অশ্লীলতাকে পুঁজি করে সিনেমাহলকে জমজমাট করার স্বপ্ন দেখেছিলো; অথচ দর্শক দূরে চলে গেছে। দর্শক বোঝে, আর যাই হোক, সিনেমাহলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া যায় না। কেনো এমন হচ্ছে? কেমন ছিলো আমাদের সিনেমাহলের শুরুর গল্প? ১৯৩১-এর দ্য লাস্ট কিস অথবা ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সবাক সিনেমা মুখ ও মুখোশ; ব্রিটিশ আমলে ১৯ শতকের একদম শেষ দিকে আরমানিটোলায় (প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ‘পিকচার হাউজ’, পরে ‘শাবিস্তান’) তৈরি সিনেমাহল¾সেই সব দর্শক কোথায়? যারা ভীষণ সেজেগুজে, গায়ে সুগন্ধি মেখে দলবেঁধে, সবাই মিলে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সিনেমাহলে আসতো। সেই সময়, যখন সিনেমা দেখা পরিবারের উৎসব ছিলো। এ শহর, এদেশের মানুষের সিনেমা দেখার বয়স প্রায় একশো ১৫ বছর (১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকা অনুযায়ী)। সেসব দর্শক এ বিনোদন থেকে দূরে চলে গেলো?

২.

যখন প্রচুর মানুষ ব্লু-রে ডিস্কে পৃথিবীর সব সিনেমা ঘরে বসে দেখছে, তখন হলিউডের আশঙ্কা¾মানুষ সিনেমাহলে যাতায়াত বন্ধ করে দিতে পারে, দর্শকশূন্য হতে পারে সিনেমাহলগুলো। এসব মাথায় রেখেই থ্রি-ডি সিনেমা বিনির্মাণ এবং সার্থকভাবে গ্রাভিটি সিনেমার সারা দুনিয়া জয়। ফোর-ডি, সিনেমা টেকনোলজির আরেক অভিজ্ঞতা। আসছে ‘স্মেল ও ভিশন’, সিনেমাহলে দর্শক দৃশ্যের আবহ হিসেবে সুগন্ধ পাবে। এসব চেষ্টা খুব হাস্যকর, ইতিহাস জানে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম থ্রি-ডি সিনেমা বানানো হয়, সেটা খুব সস্তা বুদ্ধি ছিলো। ওয়ানা ডেভিল সিনেমার বিজ্ঞাপনে প্রতিশ্রুতি ছিলো ‘টেলিভিশনের থেকেও নতুন কিছু’। স্মেল ও ভিশনের স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলেন মাইক টড; তিনি দারুণ এক পথপ্রদর্শক ছিলেন, আর জীবনের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন এলিজাবেথ টেলরের সঙ্গে। টড অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ (১৯৫৬) সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে মাইক টড বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে তার ছেলে মাইক টড জুনিয়র বাবার স্মেল ও ভিশনের কাজ সমাপ্ত করেন। অবশেষে সেন্ট অব মিস্ট্রি (১৯৬০) মুক্তি পায়। এসবই ছিলো দর্শককে সিনেমাহলে নিয়ে আসার গিমিক।

সিনেমাহলে দর্শক আসছে না¾এটা বহু পুরনো তর্কের বিষয়। কিন্তু আমাদের দর্শকরা কোথায়? আমাদের সিনেমা নির্মাণের যখন শিশুকাল, ঠিক তখন এক বিশাল দর্শক বাহিনী তৈরি হয়েছিলো। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের একটি ‘ইয়ার বুক’-এ তথ্য পাওয়া যায়, ৫০ দশকের মধ্যভাগে শুধু ঢাকায় ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর ছিলো ২৪টি। সেসব দর্শক আজ কোথায়? তারা বাসায় বসে কম্পিউটার-টিভিতে সিনেমা দেখছে; টিভি চ্যানেলের সময়ও শেষ অথবা ফেইসবুক বড্ডো বেশি সময় নিচ্ছে।

৩.

অনেকেই আমাকে বলে, সিনেমা নিয়ে যারা বিদেশে টাকা-পয়সা-মেডেল-সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, তাদের কথা কেনো বলছেন না। আমি সবসময় বলি, এখনো বলছি¾যারা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা শিখে ফেলেছেন, যারা বিদেশি ফেস্টিভালে লাল গালিচায় হাঁটেন, তারা আমাদের দেশের দর্শক নিয়ে ভাবেন না। তাদের মনজিলে মকসুদ আলাদা।

যেকোনো যাত্রায় পৃথক পৃথক ফল পাওয়া যেতে পারে। আগে এমনটা হতো না, আজকাল হয়। সিনেমা যারা নির্মাণ করছেন তাদের যাত্রাপথ এতটাই জটিল যে, তাদের কোথায় প্রাপ্তি আর কোথায় সৃষ্টিসুখ তা শুধু ভগবানই জানেন! পর্দায় তার ছায়ামাত্রও থাকে না। প্রথম যখন আন্তঃজেলা রাতের বাস যাতায়াত করতে শুরু করলো, তখন প্রতি বাসে পুলিশ-আনসারের উপস্থিতি ছিলো, তার পরও রাতের দুর্ঘটনাকে পাশ কাটানো কঠিন হতো। ওই সময়ে এক রাতে বাসের ভিতর ডাকাতদের আক্রমণে আমার অসহায় যাত্রী হওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো। আবার এ সময়ের আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে কোনো পুলিশ-আনসারের উপস্থিতি ছাড়াই সাহসী যাত্রীদের সঙ্গে আমিও আছি। প্রায় দু-দশকের তফাৎ দুটো যাত্রায় দেখেছি¾মানুষ এখন অনেক হিসেবি, কোনো ঝামেলায় থাকে না। অন্য কাউকে সাহায্য করা দূরের কথা, নিজের জীবন বাঁচানোর কৌশলও তারা জানে না। জীবন-যাপন-জীবিকা প্রতিদিন আমাদের মনস্তত্ত্বে নতুন নতুন সংবাদ দেয়, আর আমরা আচরণ-স্বভাব বদলাতে চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষের সাহায্যে আসার মানসিক সাহস আমরা বহু বছরে হারিয়ে ফেলেছি। এ তো সময়ের শিক্ষা, প্রত্যেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমাদের স্বার্থে। সুতরাং দলগত কোনো কিছুই আজ দারুণভাবে শেষ করতে পারছি না।

অথচ সিনেমা একটি দলগত প্রচেষ্টার ফসল। একজন মানুষের স্বপ্ন-বিশ্বাস-অভিজ্ঞতা দলের ভিন্ন ভিন্ন সদস্য ধারণ করে, নিজস্ব দক্ষতায় তা দৃশ্যমান করে। একজন একটু বিরক্ত হয়েই বললো¾‘ভাই টিম ওয়ার্ক তো, বুঝলাম। টিম ওয়ার্ক না হলে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ৮১টি সিনেমা রিলিজ হয়?’’ সত্যি তো এতগুলো সিনেমা নির্মাণ তো সহজ কথা নয়, আর এই শিল্প তো দারুণ সফল। সফলতা মানে আমরা লগ্নির টাকা লাভসহ উঠে আসাকেই বুঝি। এ বছরের (২০১৪ খ্রিস্টাব্দ) সর্বাধিক সিনেমায় লগ্নি করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, সরকারি অনুদানের ১০টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এদেশে সিনেমার দারুণ সুদিন। গত কয়েক বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত তালিকাকে আলোচ্য এই বছর অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। যাত্রা শুভ হোক। যাই হোক, এই টিম ওয়ার্কের সফলতা নিশ্চয়ই প্রযোজক দেখতে পাচ্ছেন। ‘অশ্লীল’’ আর নকল সিনেমাও তালিকায় ছিলো এই ২০১৪ খ্রিস্টাব্দেই, আজও মৌলিক গল্পের নাকি দারুণ অভাব!

আমাদের এই সব সিনেমার পিছনের গল্পটা প্রায় একই, একজন পরিচালকের দারুণ স্ট্রাগল। তারা খেয়ে, না খেয়ে প্রযোজক খুঁজতে থাকেন, লগ্নিকারীরা ধরা দেয় না। প্রযোজকদের থাকে দারুণ সব চুক্তি, সেসব ম্যানেজ করতে করতে পরিচালক একদিন সবুজ সংকেত পান। তখন নায়ক-নায়িকা নির্বাচন, লোকেশন ফাইনাল আর নিজের টিম তৈরি করা। কিন্তু গল্প? আরে একটা লাইন আপ তো আছে, লোকেশনে সাইজ করে ফেলবো। আমি তো হতবাক, গল্পটাই তো আসল। তারা (পরিচালক) বলে, আরে ভাই গল্প ঠিক করার টাইম পাই নাই তো, দেখলেন না কী যন্ত্রণায় সবকিছু ম্যানেজ করলাম।

৪.

সিনেমায় গল্পের প্রয়োজন আছে কি? সাত দিনের বিতর্ক অনুষ্ঠান করেও এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। কারণ, পরিচালকের মনজিলে মকসুদ কেউ জানে না। আমি একটা দারুণ গল্প লিখবো¾এমন করে কি গল্প লেখা যায়? ১৩০৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলাত যাত্রায় ক্ষণিক বিরতি হয় কুন্নুরে। কুন্নুর তামিলনাড়ুর নীলগিরি জেলায়। পিঠাপুরমের মহারাজা কবির জন্য বাগানে এক কটেজে থাকার ব্যবস্থা করেন। এক ঘরে কবি আর অন্য ঘরে প্রশান্তচন্দ্র আর নির্মলকুমারী। পাশের কটেজে এনড্রুজ আর আর্যনায়কম। বর্ষাকাল, দারুণ ঝমঝমে বৃষ্টি। সন্ধ্যায় নির্মলকুমারীর আবদারে কবিকে মুখে মুখে বানিয়ে এক গল্প শোনাতে হলো।

গল্পটি এমন¾‘‘টিং টি টিং টেলিফোন বেজে উঠেছে, বাড়ির একটি মেয়ে গিয়ে ধরল টেলিফোন¾ও প্রান্ত থেকে যে কথা কইছে তার গলা অচেনা, ছেলেটি কিছুতেই নামও বললে না। খানিকটা কথা হবার পর হঠাৎ টেলিফোন থেমে গেল। মেয়েটি তো অবাক! কে, কী বৃত্তান্ত, কিছুই জানে না, অথচ কথা বলবার পর থেকে বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পরদিন আবার ঘণ্টা। ক্রমে এমন হলো যে, মেয়েটা রোজ অপেক্ষা করে থাকে বিকেল বেলা টেলিফোন বাজবে ব’লে। যে ছেলেটি কথা বলে সে কিছুতেই নাম ঠিকানা বলে না। শুধু এইটুকু বলেছে যে সেও কখনো মেয়েটিকে দেখেনি, তবু তার কথা এত শুনেছে যে, আলাপ না করে থাকতে পারল না। মেয়েটির বাড়িতে যে সে আসতে চায় না, তার কারণ পাছে দেখা হলে তার এই ভাললাগাটুকু চলে যায়, তাই সে দূরে দূরেই রইল। টেলিফোনের ভিতর দিয়ে এই যে পরিচয় সেইটুকুতেই সে খুশী থাকবে। মেয়েটির কথা কার কাছ থেকে শুনেছে, তাও সে কিছুতেই বলতে রাজি নয়। এই রকম করে টেলিফোনের আলাপ যখন জমে উঠেছে এমন সময় হঠাৎ একদিন ছেলেটি বললে সে বিদেশে চলে যাচ্ছে কাজেই আর গল্প করা হবে না। কিছুদিন পর মেয়েটি শিলং পাহাড়ে চেঞ্জে গেল। সেখানে একদিন আকস্মিক গাড়ির দুর্ঘটনা। যে ভদ্রলোক সাহায্য করলেন তাঁর গলা শুনে মেয়েটি চমকে উঠল, তিনিও বুঝলেন কাকে সাহায্য করেছেন। টেলিফোনের ভিতর দিয়ে তাদের এত ঘনিষ্ট পরিচয় হয়েছিল যে পরস্পরকে চিনতে একটুও দেরি হল না।’

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস, নরওয়ের রাস্তা দিয়ে মোটরগাড়ি ছুটে চলছে। গাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেড়াতে চলছেন কোথাও। কবির সঙ্গে রয়েছেন নির্মলকুমারী। হঠাৎ কবি বলতে শুরু করলেন¾‘একটা কথা মাঝে মাঝে ভাবি, আধুনিক কালের ছেলেমেয়েরা কিন্তু রোমান্স করতেও জানে না। তাই আধুনিক সাহিত্যের আজকাল এই রকম চেহারা। সবই যেন স্থূল। কোনো সুন্দর জিনিসই সুশ্রীভাবে ভোগ করতে জানে না। সবেতেই লোলুপতার ছাপ লেগে কুশ্রী হয়ে ওঠে। আগেকার দিনে বিবাহটাকেও লোকে রসিয়ে ভোগ করতে পারত। তাই মিলনের সমানই তাতে আনন্দ পেয়েছে বেদনার মধ্য দিয়ে। এদেশের পুরনো কালের সাহিত্যে তার পরিচয় পাই। আর আজকের দিনে যাকে সকলে আধুনিক সাহিত্য বলছে, তার মধ্যে কেবলই বাস্তবের দোহাই দিয়ে সুন্দরের অপমান। বিধাতা আমাদের কল্পনা শক্তি দিয়েছেন কেন? প্রতিদিনের জীবনযাত্রার দৈন্যের মধ্যেও নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে সৌন্দর্য রচনা করে তো সে দৈন্য খানিকটা ঘোচাতে পারি। সাহিত্য তো সেই কাজই করবে।

ধর, একটি ছেলে ও মেয়ে পরস্পরকে ভালোবাসে এবং তারা পেয়েওছে পরস্পরকে। তবু তারা এমনভাবে চলতে পারে যাতে গোড়াকার রোমান্স চিরকালই বজায় রাখা যায়। যেমন, একটা ভাল মিউজিক কখনো পুরানো হয় না। ধর, তারা নিয়ম করল প্রতিদিন দেখা হবে না। যেদিন হবে সেদিন বিশেষভাবে যত্ন নিয়ে সাজসজ্জা করবে। মেয়েটা যদি বাজাতে জানে এমন হয়, তবে তার যন্ত্রটা কাছে নিয়ে তার প্রিয়তমের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। আকাশে চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে, সমস্ত প্রকৃতি যেন আজ বিশেষভাবে প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। মেয়েটি আস্তে আস্তে তার বীণায় ঝংকার দিচ্ছে আর ভাবছে এই বুঝি এল। দুদিকে দুখানা বাড়ি মাঝখানে দীঘি দিয়ে পৃথক করা, আর তার উপরে সাঁকো। মেয়েটির কাছে অনুমতি না পেলে ছেলেটি তার কাছে আসতে পারবে না¾এ নিয়ম তারা নিজেরাই করে রেখেছে।’

আসলে গল্পের ভাবনা চলতে থাকে অনেক গভীরে; অনেকদিন ধরে। ভিতরে ভিতরে ‘‘প্রাণের বাসনা, প্রাণের আবেগ’’ আত্মগোপন করে থাকে কবির চিত্তে। আমাদের পরিচালকরা গল্পকে ভীষণ তুচ্ছজ্ঞান করে, জানেও না কীভাবে গল্প বলতে হবে¾সব ‘‘কোপা শামসু’র দল।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাসেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং পাহাড়ে কিছুদিন কাটিয়ে যান কিন্তু কিছুতেই তখন কোনো নতুন গল্প লেখায় একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। নানা সময়ে বলেছেন, ‘‘বাইরে থেকে তেমনভাবে কেউ না খোঁচালে লেখা বেরয় না। অনেকটা ঐ খেজুর গাছের রসের মতো।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতো কথাই বলুন না কেনো, এই দু-বছর তার বিভিন্ন কথায় বোঝা যায় তিনি তৈরি হচ্ছিলেন। ‘‘শেষের কবিতা’’ তখন লেখা না হলেও কাটাকুটি চলছিলো মনে মনে।

৫.

একজন মানুষ কখন সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালক হবো? কেনো সিনেমা তৈরি করতে হবে? হয়তো এর হাজারো উত্তর আছে, যুক্তি আছে, আর আছে অল্প জ্ঞানের উপচে পড়া বুদ্বুদ। তাহলে একজন পরিচালক কেমন করে বেড়ে ওঠে?

জহির রায়হান। ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি স্কুলের নীচের ক্লাসের ছাত্র, বড়ো ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রভাবে রাজনীতির সংস্পর্শে চলে আসেন। বাবার দেওয়া জহিরউল্লাহ নাম পার্টি পরিচয়ের ছদ্মনামে হারিয়ে গেছে; হয়েছেন রায়হান, পরবর্তী সময়ে জহির রায়হান। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় বিপ্লবী, এ আন্দোলনের সার্থক উপন্যাস¾‘আরেক ফাল্গুন’’ তার অনবদ্য সৃষ্টি। ৫০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সিনেমার সঙ্গে। ৬০-এর দশকের শুরুতে পরিপূর্ণ পরিচালক হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি (১৯৬১), কাচের দেয়াল (১৯৬৩) নির্মাণের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক সিনেমা বানিয়েছেন, এতে তার শিল্পীসত্তা যতটুকু বিপর্যস্ত হয়েছিলো, যে তীব্র মানসিক যাতনার তিনি শিকার হয়েছিলেন¾তা কিছুটা লাঘবের জন্য তিনি আবার ঠাঁই নিয়েছিলেন সাহিত্যে। ‘‘হাজার বছর ধরে’, ‘‘ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’ আর ‘‘কতগুলো কুকুরের আর্তনাদ’’-এর মতো লেখায় হয়তো সে জ্বালা কিছুটা কমেছিলো। ভাষা আন্দোলনের ওপর তিনি যে সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারী, তা সরকারের অনুমতি পায়নি। ব্যবসায়িক অসফল এ ধরনের সিনেমার জন্য সেসময় কোনো প্রযোজকও এগিয়ে আসেনি।

আর একজন পরিচালক, খান আতাউর রহমান¾গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা ও পরিচালক। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভর্তি হন সিটি লিটারারি ইন্সটিটিউটের নাট্যকলা বিভাগে। লন্ডনে একটি কলেজে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন থিয়েটার কোম্পানিতে প্রায় দুই বছর কাজ করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ফিরে তিনি এ জে কারদার-এর জাগো হুয়া সাভেরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের বিপরীতে অভিনয় করেন প্রধান চরিত্রে। তার রচিত ও সুরারোপিত আধুনিক, দেশাত্মবোধক, শিশুতোষ ও বিষয়ভিত্তিক গান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র অনেক দিনের চেনা (১৯৬৩)।

৬.

তাগিদবোধ বা কোনো অঙ্গীকার ছাড়া শিল্পের সেবা করা যায় না। কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত কিংবা অন্য কোনো কাজ জানা নেই বলে পরিচালক হতে হবে¾এমন চিন্তা এ শিল্পকে বিপন্ন করছে। একটা কথা আজকাল প্রায় শুনতে হয়, সিনেমার এই দৃশ্যটা দারুণ; অসম্ভব সুন্দর ফ্রেম। কতকগুলো সুন্দর ফ্রেম মানে সিনেমা নয়, আর গল্পের সঙ্গে তা হয়তো ভীষণ অনর্থক। ডিজিটাল কারণে অনেক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কিন্তু একজন পরিচালকের খুব জরুরি না যে টেকনিকাল বিষয়টা বুঝতে হবে। ফোর-কে বা টু-কে নিয়ে যাদের জীবনে দিনের একটা লম্বা সময় কেটে যায়, তাদের বলছি, আমাদের সিনেমাহলগুলোর প্রজেকশন একদম নবজাতকের মতো। সুতরাং অনেক সময় লাগবে, অস্থির হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নাই।

কিছু কিছু শব্দ জ্ঞান জাহিরের জন্য বলতে শুনি, সেসব খুব অল্প শব্দ দিয়ে বলতে চাই। শিল্প আন্দোলনের শুরুর দিকে মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদে যা ব্যবহৃত হয়, সেটি ছিলো সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ। সময়টা ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত। সুররিয়ালিস্টরা ফ্রয়েডের স্বপ্ন ও অবচেতনের ধারণা ও তত্ত্ব দ্বারা আবদ্ধ হন। তাদের কাছে সিনেমার ভাষার কিছু অংশ যেমন¾ডিজলভ, স্লো মোশন, সুপার ইম্পোজিশন ইত্যাদি স্বপ্নের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়।

সুররিয়ালিজম বিষয়টা একটু সহজ করা দরকার। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে এই সব পরাবাস্তববাদীদের চলাফেরা। এ আন্দোলনে ফসল ঘরে তুলেছিলো চিত্রকররা। যদিও এ আন্দোলনের দলপতি ছিলেন আঁদ্রে ব্রেঁতো, একজন কবি; তবুও এ হয়ে উঠলো নবীন ও স্বাধীন এক শিল্পধারা। ব্রেঁতো প্রথম মহাযুদ্ধের সময় একজন মনঃসমীক্ষক ছিলেন। তার আবিষ্কার ফ্রয়েডিয় মতবাদ শিল্পের দেশে এক অসাধারণ বিপ্লবী ঘটনা, আর তাতে শিল্পের নতুন দরজা খুলে যাওয়ার জোগাড়। পরাবাস্তববাদের ‘অটোমেটিজম’’ সিনেমায় ভীষণ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রায়োগিক। বরং সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেঁতো’র ইশতেহারের ঘোষণা পাঠ করা যেতে পারে¾বিস্ময় সবসময় সুন্দর। যা কিছু বিস্ময়কর তাই সুন্দর, আর শুধুমাত্র বিস্ময়ই সুন্দর।

প্রতিটা ফ্রেমে ফ্রেমে বিস্ময় থাকলে তা স্থিরচিত্র হবে, সিনেমা হবে না। যারা দাদাদের কথা বাদ দিয়ে সুররিয়ালিস্টদের কথা বলেন, তাদের বলবো, ওই সময়ের আরো তিনটি উজ্জ্বল শিল্প আন্দোলনের কথা বলুন : (১) নিও-রোমান্টিসিজম, (২) ম্যাজিক রিয়ালিজম, (৩) অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম। এগুলো একজন নির্মাতাকে জানতে হবে।

৭.

শুরুতে বলেছিলাম, আমাদের সিনেমাগুলো সিনেমা হয়ে উঠছে না। এর প্রধান কারণ চিত্রনাট্য। ভালো চিত্রনাট্য বোঝার বা পরীক্ষার সহজ উপায়¾সাহিত্যবোধ, চলচ্চিত্রবোধ আর সবকিছুর অতল দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা। এসব শেখার জন্য কোনো দেয়াল টপকিয়ে, অন্যের বারান্দা দিয়ে শর্টকাট রাস্তা নাই; প্রয়োজন প্রস্তুতি, অনুশীলন আর অভিজ্ঞতা।

লেখক : সেলিম আহমেদ, স্নাতক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে ভাস্কর্যে। দীর্ঘ সময় হস্তশিল্প, ফ্যাশন ও গ্রাফিক্সের সঙ্গে তার বসবাস। বর্তমানে তৈরি হচ্ছেন চলচ্চিত্র-নির্মাণের জন্য।

selim24march@yahoo.com

পাঠ সহায়িকা

১. ঠাকুর, শ্রী রবীন্দ্রনাথ;শেষের কবিতা পাণ্ডুলিপি; সম্পাদনা : অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ও সবুজকলি সেন; বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলিকাতা।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন